চাই ইতিবাচক চিন্তা

দুঃখ ছাড়া কোনো জীবন হয়না। প্রতিটি মানুষের জীবনেই কিছু অপূর্ণতা থাকে। অধিকাংশ মানুষকে বাইরে থেকে হাসি-খুশি মনে হলেও সবাই শতভাগ সুখি কেউ নয়। একেকজন মানুষের রয়েছে একেক রকম না পাওয়া। আমাদের চেষ্টা করতে হবে, এই না পাওয়াগুলোকে ভুলে, আমরা কিভাবে সামনে এগিয়ে যেতে পারবো সেই চেষ্টা করতে হবে। মন ভালো রাখার জন্য সব সময় ইতবাচক চিন্তা করতে হবে। আমাদের মন যতো বেশি ভালো থাকবে, আমরা মানসিকভাবে হব ততোটাই শক্তিশালী। মানসিক শক্তি বাড়ানোর জন্য আমাদের প্রবল ইচ্ছাশক্তি থাকা ভীষণ জরুরি।

ধর্ম, কর্ম, ইয়োগা, ধ্যান, মেডিটেশন, সৃজনশীল কাজ, নিজেকে জনকল্যাণমূলক কাজে নিয়োজিত রাখতে পারলে আমরা ভালো থাকবো। এই ধরণের কাজগুলো বাড়িয়ে তোলে আমাদের মানসিক শক্তি। চেষ্টা করতে হবে জীবিকার পাশাপাশি সৃজনশীল কাজ বা আত্মউন্নয়নমূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখার জন্য। তাহলে নেতিবাচক চিন্তা, হতাশা, দুঃখ, কষ্ট সহজে মনকে দুর্বল করতে পারবে না। আপনি যে ধর্মেরই হোন না কেন; নিয়মিত ধর্মকর্ম, মেডিটেশন, ধ্যান আপনাকে দিবে মানসিক প্রশান্তি। প্রতিটি ধর্মের প্রার্থনায় ধ্যান বিষয়টা কিছুটা হলেও চলে আসে। তাই নিয়মিত ধর্মকর্ম করলে মস্তিষ্কের বিশ্রাম হয়। মস্তিষ্কের বিশ্রাম হলে মানুষের মস্তিষ্ক দ্বিগুণ কর্মক্ষম হয়ে ওঠে। আমাদের মাথার মধ্যে রয়েছে অগণিত শিরা-উপশিরা ও স্নায়ু। আমরা যখন ঘুমিয়ে থাকি তখনও এই শিরা, উপশিরা ও স্নায়ু কাজ করতে থাকে। তবে জেগে থাকা অবস্থায় মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলো কাজ করে তুলনামূলকভাবে বেশি।

কর্মতৎপর স্নায়ু

মাতৃগর্ভে থাকাকালীন একটি শিশুর মস্তিষ্ক তৈরি হতে থাকে। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত চলতে থাকে মস্তিষ্কের বিরামহীন যাত্রা। আমরা যখন প্রার্থনা, ধ্যান বা মেডিটেশান করি তখন আমাদের মস্তিষ্কের শিরা-উপশিরা ও স্নায়ুগুলোর বিশ্রাম হয়। অনেক কাজ করার পরে মানুষের যেমন বিশ্রাম প্রয়োজন, ঠিক তেমনই আমাদের মস্তিষ্কেরও বিশ্রাম প্রয়োজন। আমাদের মস্তিষ্কে রয়েছে মাকড়শার জালের মতো অসংখ্য স্নায়ু। এই স্নায়ুগুলো মাথা থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত বিস্তৃত। স্নায়ুগুলো যতো বেশি কর্মতৎপর হবে, আমরা ততো বেশি কর্মক্ষম হয়ে উঠবো। সেজন্য ইতিবাচক চিন্তা, ধর্মকর্ম, ভালোলাগার কাজগুলো ভীষণ জরুরি। আমাদের রক্তে হরমোন নামে ভীষণ জরুরি এক উপাদান রয়েছে। হরমোনগুলো সংখ্যায় একাধিক এবং প্রতিটি হরমোন দেহের জন্য পালন করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সৃজনশীল কাজ, ধর্মকর্ম, ইয়োগা, মেডিটেশন আমাদের রক্তে সেরোটোনিন নামের এক ধরণের হরমোন লেভেলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এই হরমোনের মাত্রা রক্তে বৃদ্ধি পেলে, মানুষ কাজে উৎসাহ পায়। মানুষের আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়।

ঘুরে দাঁড়ান

জীবনে ব্যর্থতা থাকবেই। আমাদের চেষ্টা করতে হবে, বারবার ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য। জীবনের ধ্বংসস্তুপের মাঝেও ইতিবাচক চিন্তা আমাদের দেবে মানসিক শক্তি। জোর করে মন ভালো করার চেষ্টা করতে হবে। যতো বেশি হতাশা বা বিষণ্নতা আমাদের গ্রাস করবে, আমরা ততোটাই এগিয়ে যাবো ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপের দিকে। পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশসহ বর্তমানে বাংলাদেশেও অসংখ্য তরুণ তরুণী ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপে আক্রান্ত। এর অন্যতম প্রধান কারণ দুঃখ, কষ্ট, অতিরিক্ত মানসিক চাপ, হতাশা, বিষণ্নতা। বছরের পর বছর হতাশায় আক্রান্ত হওয়ার কারণে আমাদের সমাজে অনেকেই মানসিক রেগের শিকার হয়। যা অনেক সময় ধরা পড়েনা। মানসিক রোগ অনেক সময় চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে ধরা পড়ে। এই ধরণের পরিণতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য আমাদের নিজেকে ভালোবাসতে হবে। নিজেকে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ রাখার জন্য সব সময় ইতিবাচক চিন্তা করতে হবে।

 

সৃজনশীল কাজ

আপনার সৃজনশীল কোনো কাজের প্রতি ভালোবাসা থাকলে সেই কাজগুলো করার চেষ্টা করবেন। ইউটিউবে বিভিন্ন ধরণের আত্মউন্নয়নমূলক ভিডিও আছে। এই ধরণের ভিডিওগুলো বাড়িয়ে তুলবে আমাদের মানসিক শক্তি। বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তি বিভিন্ন সময়ে বক্তৃতা দিয়েছেন বা তাদের সাক্ষাৎকারগুলো দেখলেই আমরা উপলব্ধি করতে পারবো যে, তারা কতোটা দুঃখ, কষ্টকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে গেছেন। পৃথিবীর অসংখ্য মনীষী সীমাহীন যুদ্ধ করে, অনেকেই চরম অভাব ও দারিদ্র্য জয় করে সফল হয়েছেন। ইতিহাসের পাতায় লিখিয়েছেন তাদের নাম। তাদের জীবনী পর্যালোচনা করলেই দেখা যাবে, তারা প্রায় সবাই ছিলেন ইতিবাচক চিন্তার মানুষ। ইতিবাচক চিন্তা মানুষের আত্মবিশ্বাসকে বাড়িয়ে তোলে কয়েক গুণ। আমরা চোখের পানি লুকিয়ে ইতিবাচক চিন্তা করবো। জীবনযুদ্ধে আমাদের সফল হতেই হবে।

 

একজন মহীরুহ রণদা প্রসাদ সাহা- ফারহানা মােবিন।

একজন সাধারণ
মানুষই হয়ে ওঠেন | মনীষী বা মহিরুহ।।
হয়ে ওঠেন ইতিহাসের স্বর্ণালি অধ্যায়, যখন তাঁর কর্মজগৎ মানুষকে | আলােড়িত করে, | তাঁর পরিশ্রমী জীবন হয়ে ওঠে মহৎ উদাহরণ। এমনই একজন হলেন রণদা প্রসাদ সাহা। যাঁর জীবনসংগ্রাম | বটবৃক্ষের মতাে দৃঢ়
আর সফলতা আকাশের মতাে ব্যাপক ও বিস্তৃত। রণদা প্রসাদ সাহা, যাঁর অপর নাম হলাে আরপি সাহা। যিনি জন্ম গ্রহণ করেন ঢাকার সাভারে ১৮৯৬ সালের ১৫ নভেম্বর। তাঁর বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ কুমার সাহা এবং মা হলেন কুমুদিনী সাহা। মাত্র সাত বছর বয়সে তিনি তাঁর মাকে হারান। | তাঁর মা সন্তান জন্ম দানের সময় টিটেনাস নামক একধরনের ইনফেকশনজনিত রােগে মারা যান। দরিদ্রতা ও চিকিৎসার অভাবে পরপারে চলে যান তাঁর মা। মাত্র সাত বছরের শিশুর মনে এই বিষয়টি গভীরভাবে প্রভাব ফেলে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, তিনি বড় হয়ে এমন কিছু করবেন, যেন কোনাে মা এভাবে সন্তান জন্ম দানের সময় চিকিৎসার অভাবে মারা না যান। | তাঁর এই স্বপ্নই পরবর্তী কালে নেয় সত্যের রূপ তাঁর চারপাশ ঘিরে ছিল দারিদ্র্যের অক্টোপাস। অর্থাভাবে তিনি মাত্র ১৬ বছর বয়সে নতুন জীবনের সন্ধানে কলকাতায় গমন করেন। তিনি তৃতীয় শ্রেণির বেশি পড়তে পারেননি। অর্থাভাবে তিনি ১৬ বছর বয়সে কলকাতায় গিয়ে কুলিগিরি থেকে শুরু করে সব রকম কাজ করেন।
জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়া এবং মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিয়ােজিত করার জন্য তিনি দিন-রাত পরিশ্রম করতে থাকেন। সমাজের সব শ্রেণির মানুষ বিশেষত দরিদ্র, অসহায়, বঞ্চিত ও অবহেলিত নারী সমাজের উন্নতির জন্য তিনি নিজের জীবন, ধনসম্পদ সব অকাতরে বিলিয়ে দেন। অক্লান্ত, অমানবিক পরিশ্রম করে তিনি সাফল্যের স্বর্ণ শিখরে পৌঁছে যান। তাঁর জীবন বিচিত্রতায় ভরপুর। একসময় স্বদেশি আন্দোলনে অংশ নেন। প্রথম মহাযুদ্ধেও তিনি অংশ নেন। প্রথমে আর্মি অ্যাম্বুলেন্স এবং পরে যুক্ত হন ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টনে। শ্রম, মেধা আর বীরত্ব দিয়ে তিনি অর্জন করেন ‘সাের্ড অব অনার। সম্রাট পঞ্চম জর্জ তাঁকে বিলেতে (বর্তমান লন্ডন) আমন্ত্রণ জানান। রেলস্টেশনে কিছুদিন চাকরি করেন। চাকরি করার পরে কয়লা এবং নৌপরিবহনের ব্যবসা শুরু করেন। এভাবে বাঙালিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত বেঙ্গল রিভার সার্ভিসের যাত্রা তাঁর মাধ্যমে। | তিনি পড়ালেখা করার সুযােগ পাননি। কিন্তু পরিশ্রম ও মেধা দিয়ে ব্যবসা করে তিনি উপার্জন করেন অনেক অর্থসম্পদ।
| তিনি লবণ, কয়লা, জাহাজ, চামড়া, খাদ্যদ্রব্য, পাওয়ার হাউসের ব্যবসা করেন। তাঁর ব্যবসা ক্ষেত্রের মাধ্যমে তিনি অনেক দরিদ্র পরিবারের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন। একই সঙ্গে নারী শিক্ষা, দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থান, সমাজ থেকে কুসংস্কার দূর করার জন্য তিনি সামাজিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলনে রাখেন গুরুত্বপূর্ণ ভ,মিকা। অসহায় অসংখ্য পরিবারকে তিনি অর্থ দিয়ে সাহায্য করেন। সমাজ থেকে ধর্মীয় ও অন্ধকারাচ্ছন্ন কুসংস্কারগুলাে দূর করার জন্য তিনি গড়ে তােলেন সামাজিক আন্দোলন। দরিদ্র মানুষকে দান করার জন্য তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন দানবীর নামে। বিভিন্ন স্থানে স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠায় তিনি সাহায্য করতে থাকেন। ত্রিশের দশকের দিকে দেখা দেয় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। | হাজার হাজার মানুষ মরতে থাকে। তিনি নিজের অর্জিত অর্থে দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে তােলেন প্রায় ৩০০ লঙ্গরখানা। টানা আট মাস এই লঙ্গরখানার মাধ্যমে তিনি দেশের অসহায়, অনাহারী মানুষগুলােকে খাবার দিয়েছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে তুলেছেন দাতব্য চিকিৎসালয়। তাঁর নিজের এলাকায় নিজ অর্থে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন কুমুদিনী হাসপাতাল। | এই হাসপাতালটিই বর্তমানে রূপ নিয়েছে বিশাল এক প্রতিষ্ঠানে।। | একই সঙ্গে এটি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ। এখানে দুস্থ মানুষের চিকিৎসা হয়।
তিনি ছিলেন নারী শিক্ষার একজন অগ্রগামী দূত। | অবহেলিত নারী সমাজের জন্য তিনি গড়ে তুলেছিলেন ভারতেশ্বরী হােমস। টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে রয়েছে এই প্রতিষ্ঠানটি। তিনি টাঙ্গাইলে প্রতিষ্ঠা করেন কুমুদিনী মহিলা কলেজ। | মানিকগঞ্জে গড়ে তােলেন দেবেন্দ্র কলেজ। রণদা প্রসাদ সাহা তাঁর বিভিন্ন ধরনের জনহিতৈষীমূলক কাজের জন্য গঠন করেন কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট। নারী জাগরণ, সমাজ থেকে কুসংস্কার দূর করার জন্য তিনি কাজ করে গেছেন নিরলসভাবে। | তাঁর সময়ে নারীরা ছিল অনেক অবহেলিত ও বঞ্চিত। তিনি সেই বঞ্চিত নারী সমাজের জাগরণ, সমাজ থেকে কুসংস্কার দূর করা এবং সমাজের অসহায় মানুষগুলােকে সাহায্য-সহযােগিতা করার জন্য ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। আমৃত্যু তিনি সমাজের উন্নতির জন্য কাজ করে গেছেন। তিনি ছিলেন সফল ব্যবসায়ী। শিল্পসাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি ছিল তাঁর প্রবল আকর্ষণ। তিনি বিশ্বাস করতেন যে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে সমাজকে পরিবর্তন করা সম্ভব।
এই বােধ থেকে ১৯৫৫ সালে মির্জাপুর আনন্দ নিকেতন নাট্যমঞ্চ প্রতিষ্ঠিত হয় তাঁর হাতে। | ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানের সময় পাকিস্তানের আইয়ুব সরকার তাঁর এই ভালাে কাজগুলােকে সম্মানে ভূষিত করেন। তিনি রণদা প্রসাদ সাহাকে ‘হেলালে পাকিস্তান’ নামে খেতাব দেন। কিন্তু তিনি এই খেতাব গ্রহণ করেননি। পাকিস্তান সরকারের খেতাব প্রত্যাখ্যান করার জন্য পাকিস্তান সরকার তাঁর প্রতি ভীষণ বিরক্ত হন। পাকিস্তানিরা বাঙালিদের অনেক অত্যাচার করেছে। এই অন্যায়-অবিচার কোনােভাবেই মেনে নেওয়ার নয়। তাই তিনি এত মূল্যবান খেতাব পেয়েও তা গ্রহণ করেননি। | খেতাব প্রত্যাখ্যান করার জন্য পাকিস্তান সরকার তাঁর কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট ধ্বংস করার অনেক অপচেষ্টা
চালান। | তাঁর বিত্ত বৈভব, ক্ষমতা ও মানুষের প্রতি দায়িত্ববােধ ভালােবাসার জন্য ব্রিটিশ সরকার তাঁকে “রায়বাহাদুর’ উপাধি | দেন। তিনি তাঁর সব অর্জিত অর্থ মানুষের কল্যাণে ব্যয় করে গেছেন। ১৯৭১ সালে ৭ মে দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা ও তাঁর ২৭ বছর বয়সী ছেলে ভবানী প্রসাদ সাহাকে পাকিস্তানি বাহিনীর | লােকেরা ধরে নিয়ে যায়। | দীর্ঘ বছর পর্যন্ত সবাই বিশ্বাস করত যে তাঁরা ফিরে আসবেন। কিন্তু তাঁরা আর ফিরে আসেননি। | তাদের লাশটাও আর পাওয়া যায় নি।