আমাদের মেডিকেল কলেজ

২০০২ সালের কথা। তখন আমি ছিলাম মেডিকেল কলেজের ছাত্রী। আমাদের মেডিকেল কলেজের ছাদটা ছিল খুব সুন্দর। ছাদটা ছিল রেলিংবিহীন। আমরা বিকেলে দলবেঁধে ছাদে উঠতাম। তখন মেডিকেল কলেজের চারিপাশে এত লোকালয়, দোকানপাট ছিল না। একপাশে ছিল ইতিহাসের সাক্ষী বিশাল বধ্যভূমি। একপাশে বুড়িগঙ্গা নদী আর একপাশে রাস্তাঘাট, কলেজ ক্যাম্পাসের পেছনের দিকে নৌকা চলত। ছাদের ওপর থেকে সেই দৃশ্যগুলো বিকেল বেলার দিকে অদ্ভূত সুন্দর লাগত, তা লিখে বোঝানোর নয়।

সূর্য ডুবে যাওয়া পর্যন্ত আমরা ছাদে থাকতাম। আমি পড়তাম মহিলা মেডিকেল কালেজে। দলবেঁধে কয়েকজন মিলে চায়ের মগ আর বিস্কুটের কৌটা নিয়ে ছাদে বসে থাকতাম। বধ্যভূমির পেছনে পালতোলা নৌকা চলত। সূর্যের আলোতে সেই দৃশ্যগুলো দেখে আমাদের মনে হতো যেন সমুদ্রসৈকতে বসে আছি। বুক ভরে নেয়া যেত সবুজ নিঃশ্বাস। আমাদের মেডিকেল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা জয়নুল হক শিকদার স্যার গাছ খুব পছন্দ করতেন। আমাদের ক্যাম্পাসটি সবুজেঘেরা। বিভিন্ন ধরনের গাছ রয়েছে আমাদের ক্যাম্পাসে। কলেজের প্রতিষ্ঠাতাকে আমরা বলতাম শিকদার আঙ্কেল।

তিনি শখের বশে ক্যাম্পাসে লাগিয়েছিলেন বহু প্রজাতির গাছ। তখন আমাদের মনে হতো, আমরা বাস করি সবুজেঘেরা একটি দ্বীপে। সন্ধ্যা হলেই আমরা ছাদ থেকে নেমে নিজেদের রুমে ফিরে যেতাম। হোস্টেলের বেলকোনি দিয়েও দেখা যেত খোলা আকাশ। আমরা পড়ার টেবিলে বসেই দেখতে পেতাম গোধূলির লালচে আকাশ দিয়ে ঝাঁকঝাঁক পাখি দলবেঁধে নীড়ে ফিরছে।

সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথে প্রতিটি রুমে লাইট জ্বলে উঠত। কেউ পড়ত, কেউ গল্প করত, কেউ হেডফোন দিয়ে গান শুনত, এই ছিল আমাদের সন্ধ্যাবেলার দৃশ্য। দলবেঁধে কঙ্কাল আর মেডিকেলের মোটা মোটা বইয়ের মাঝে হারিয়ে যেত। সিনিয়র আপুরা পরীক্ষার আগে লেখাপড়া করত সারারাত জেগে। শুরুর দিকে হতাশ হয়ে ভাবতাম এ কোন জায়গায় আসলাম আমরা এত লেখাপড়া! চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম ছোটবেলা থেকেই কিন্তু মা, ভাই-বোনকে রাজশাহীতে রেখে হঠাৎ হোস্টেল জীবনের মাঝে হয়ে যেত খুব বেশি মন খারাপ।

farhana1

সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ক্লাস হতো। রুমে ফিরে খাবার খেয়ে ক্লান্ত দেহে ঘুমিয়ে পড়তাম। মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখতাম “মা যেন বলছে সোনা কতদিন তোমাকে দেখি না, তুমি মন দিয়ে লেখাপড়া করো।” ক্লান্ত দেহটা পড়ে থাকত বিছানায় আর মনটা চলে যেত রাজশাহীতে আমার আত্মীয়-স্বাজনের কাছে। নতুন অভিজ্ঞতা, বিচিত্র সব পরিস্থিতি আর বারো রকমের মানুষের বসতি ছিল সেই হোস্টেলে।

মানুষ যে কত স্বার্থপর আর উদ্ভট হতে পারে তা হোস্টেলে না থাকলে বোঝা যায় না। কিছু নিবেদিতপ্রাণ ভালো মানুষের দেখা পেয়েছিলাম আমার হোস্টেল জীবনে। যারা আজও জড়িয়ে আছে আমার জীবনের সাথে। যেদিন ছাদে যেতে পারতাম না সেদিন আমরা দলবেঁধে রুমে চা খেতাম। চা ছাড়া আমরা একধাপ চলতে পারতাম না। চা খেতে খেতে দলবেঁধে রুমের সবাই মিলে গাইতাম সন্ত্রাসী এরশাদ শিকদারের বিখ্যাত সেই গান “আমিতো মরে যাব, চলে যাব, রেখে যাব স্মৃতি এই শিকদার মেডিকেল কলেজে….।” সেই সময় এরশাদ শিকদার নামে বিখ্যাত এক সন্ত্রাসী ছিল।

আমাদের সময়ে কলেজের দ্বিতীয় তলায় মহিলা হোস্টেল আর প্রথম তলায় ছিল ক্লাসরুম। দ্বিতীয় তলায় তিনটা কুুকুর সারাদিন আর রাত পাহারা দিত। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত না হয়েও মনে হতো যেন হোস্টেলের সবকিছু বোঝে। বিশেষ করে মেয়েদের প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস। মেয়েদের দেখে পাশে এসে কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে আবার চলে যেত। কিন্তু ছেলেদের দেখলেই করত চিৎকার। মাঝে মাঝে হোস্টেল সুপার উন্নতি আপা কুকুরগুলোকে বকা দিতেন।

একদিন রাতে আমাদের এক বান্ধবী ফুলপ্যান্ট, শার্ট পরে বাইরে বের হলো, আর সাথে সাথেই শুরু হলো কুকুরের তাড়া। কুকুরের দৃষ্টিভ্রম হয়েছিল। ভেবেছিল সেটা বোধহয় কোনো পুরুষ। কুকুরগুলো সারারাত জেগে থাকত। বুড়িগঙ্গার তীরঘেঁষে আমাদের কলেজ। কলেজের ডানপাশে রয়েছে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের বধ্যভূমি। রায়ের বাজারের এই বধ্যভূমি ৭১ এর যুদ্ধে এদেশের মানুষকে তাদের অম্লান আত্মত্যাগের কথা মনে করিয়ে দেয়।

farhana1

সেই নির্বাক কালো স্তম্ভটা যেন হাজারো কথা বলে যায় আমাদের কানে “শোনো, তোমরা স্বাধীন দেশের সন্তান, তোমরা আমাদের রক্তের বিনিময়ে এই কলেজ পেয়েছ। তোমরা আমাদের রক্তের মূল্য দিও। রাতের বেলা হেস্টেলের রেলিংয়ে দাঁড়াতাম। মনটা খুব খারাপ হলে- আকাশের তারা দেখতাম। সাদা আকাশের মাঝে হালকা মেঘের আনাগোনা আর তারই মাঝে উজ্জ্বল হয়ে যেত জোৎস্নার কিরণ। সাদার মেঘের সাথে চাঁদটাও যেন ভেসে চলত দূরদিগন্ত পানে। রূপালী আভা মনের বিষণ্নতা দূর করত।

নদীর মিষ্টি বাতাস হোস্টেলের রেলিংঘেঁষে যেত, কী যে ভালো লাগত! মনে হতো প্রকৃতি তার রেশম-কোমল হাত দিয়ে আমার মুখে অপার স্নেহ পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। দূরে গাবতলী বাস টার্মিনালের লাল নীল সবুজ হলুদ লাইটগুলো জ্বলত। দূর আকাশের তারার মতোই লাইটগুলো ঝিকিমিকি করত। হারিয়ে যেত মনটা পুরোনো স্মৃতিতে। উদাস হয়ে যেতাম আমি। আমাদের হোস্টেল সুপারের নাম ছিল “উন্নতি”। উন্নতি নামটা আমি আজ পর্যন্ত আর কারও নাম হিসেবে শুনিনি।

কলেজের প্রতিষ্ঠাতা শিকদার স্যারের কিছু অ্যাপার্টমেন্ট ছিল আমাদের মেডিকেল কলেজের পেছনে। সেই অ্যাপার্টমেন্টের ছাদে উঠলে মতো হতো- চারিদিকে পানি আর মাঝে কলেজ। আমরা যেন সমুদ্রসৈকতে থাকি। বুড়িগঙ্গার একধারে উঁচু উঁচু বিল্ডিং আর অন্যধারে ছিন্নমূল মানুষের বসতি। হোস্টেলের ছাদে বসে অনুভব করা যেত দুইধারের জনবসতির মাঝে বিস্তর ব্যবধান।

farhana1

হসপিটালের একপাশে চলত নবজাতকের জন্ম, আবার আরেক পাশে ভীষণ গুরুতর রোগীদের মরতেও দেখা যেত। একপাশে মিষ্টির বাক্স আরেক পাশে কফিনের বাক্স। এটাই বাস্তবতা। আবার অনেকেই হাসিমাখা মুখে সুস্থ হওয়ার পর ফিরত বাসায়। আমাদের ক্যাম্পাসের একপাশে ছিল কেরালার সিস্টারদের বিল্ডিং। তাদের উচ্চতা, ভাষা, চেহারা প্রমাণ দিত যে, তারা আমাদের সংস্কৃতির মানুষ নয়। তারা ভিনদেশি মানুষ। আমি যখন মেডিকেল কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি, তখন মেডিকেল কলেজে একদল কেরালা সিস্টার ছিল। তারা ছিল ইন্ডিয়ার কেরালা প্রদেশের। বাংলাদেশি মেয়েদের থেকে তুলনামূলকভাবে লম্বা তারা।

আমাদের ক্যাম্পাসের মধ্যে ছিল ভীষণ সুন্দর একটি মসজিদ। মসজিদের দুই তলায় ছিল মেয়েদের নামাজের ব্যবস্থা। আরেক পাশে ছিল মাদরাসা, গরুর খামার, ন্যাশনাল ব্যাংক, আনসার ও সিকিউরিটি বাহিনীর থাকার জায়গা, ডেন্টাল কলেজ, নার্সিং কলেজ, ছোটদের জন্য ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। রাজধানী ঢাকার বুকে বিশাল, বিস্তৃত সবুজেঘেরা ছিল আমাদের মেডিকেল কলেজের ক্যাম্পাস।

একপাশে মেডিকেল কলেজ, একপাশে বিশাল হসপিটাল। হাসপাতালের জানালা দিয়ে মাঝে মাঝে দেখতাম বুড়িগঙ্গার পানি সূর্যের আলোতে চিকচিক করছে। অদ্ভূত সুন্দর সেই দৃশ্য লিখে বোঝানোর শক্তি আমার লেখনীতে নেই। বুড়িগঙ্গার তীরঘেঁষে ছিল আমাদের ক্যাম্পাস। চোখজুড়ানো দৃশ্যের জন্য প্রায়ই সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের আমাদের ক্যাম্পাসে শুটিং করতে দেখা যেত। বিভিন্ন প্রোডাকশন হাউজ আমাদের ক্যাম্পাসকে শুটিং স্পট হিসেবে ব্যবহার করত।

farhana1

আমাদের শিকদার আন্টি (শিকদার আঙ্কেলের স্ত্রী) খুব শখ করে জনবল নিয়োগ করে সবজি চাষ করতেন। ক্যাম্পাসের একপাশে ক্ষেতের মধ্যে ফরমালিন ছাড়া টাটকা ফুলকপি, বাঁধাকপি, লালশাক, পালংশাক দেখে মনে হতো যেন সবজি নয়, ক্ষেতের মধ্যে শোপিস। আমরা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা স্যারের স্ত্রীকে বলতাম আন্টি। মাঝে মাঝে সবাই মিলে বলতাম, “যদি আল্লাহর বেহেশত বিক্রি হতো, তাহলে শিকদার আঙ্কেল সেই বেহেশত কিনে ফেলতেন।” তিনি ছিলেন ভীষণ সৌখিন মানুষ। শুক্রবারে ক্যাম্পাসের মসজিদে নামাজ শেষে, অগণিত অসহায় মানুষকে দান করতেন। আমাদের মসজিদে দূর-দুরান্ত থেকে অনেকেই নামাজ পড়তে আসতেন।

অদ্ভূত সুন্দর এই ক্যাম্পাসে থেকেও হতাশ হয়ে যেতাম আমার মা, ভাই-বোনের কথা ভেবে। তখন তারা থাকত রাজশাহীতে। আমার মনটা তাদের জন্য ছটফট করত। শুধু মনকে এই বলে সান্ত্বনা দিতাম যে, “আমাকে সামনে যেতে হবে, বড় ডাক্তার হতে হবে, আমার মা-বাবা আমাদের জন্য সীমাহীন বিসর্জন দিয়েছে, তাদের স্বপ্ন পূর্ণ করতেই হবে।”

সুখ-দুঃখ-ব্যথা নিয়েই ছিল আমাদের এই শিকদার মেডিকেল কলেজ। আমার পেশাজীবনের প্রথম ধাপ। নতুন অভিজ্ঞাতা আর নতুন পথচলার স্থান ছিল সেটি। ভালো লাগুক বা নাই বা লাগুক ওই বুড়িগঙ্গার বহমান পানির মতো পূর্বপরিচিত মানুষদের ছেড়ে আমাকে যেতে হবে আরও দূরে… আরও দূরে। সারাজীবন এই প্রতিজ্ঞা করেছি। আজ বিখ্যাত কবি রবার্ট ফ্রস্টের ভাষায় আমিও বলতে চাই…
“And miles to go before I sleep
And miles to go before I sleep.”

0 replies

Leave a Reply

Want to join the discussion?
Feel free to contribute!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *